তেলের জন্য তৈলাক্ত রাজনীতি
বিশ্ব অর্থনীতি এবং রাজনীতিতে তেল বা জ্বালানির ভূমিকা অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ। যে দেশের যত বেশি তেল বা গ্যাস রয়েছে তাদের সাথে সখ্যতায়
পশ্চিমা দেশগুলোরও রয়েছে তত বেশি আগ্রহ। ছোট-বড় অনেক যুদ্ধের সূচনা এই
তেলের কারণেই সঙ্ঘটিত হয়েছে। এমনকি এখন সিরিয়া ও ইরাকে যে যুদ্ধ চলছে, তার
নেপথ্যেও রয়েছে এই তেল। তেলের জন্য তৈলাক্ত রাজনীতি মুখের কথা নয়, বরং
বিভিন্ন আগ্রাসানের নেপথ্যে রয়েছে তেলের জন্য লালসা। তেল বিশ্বের এমন এক
অপরিহার্য উপজীব্য, প্রতিনিয়ত যার চাহিদা বেড়েই চলেছে আর তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো
দিন দিন আরো ঝুঁঁকির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র জাপানে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ায় জাপান যুক্তরাষ্ট্রের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে পার্ল হারবারে আক্রমণ চালায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের তেলসমৃদ্ধ তলপেট দখল করাই ছিল জার্মানির অন্যতম লক্ষ্য। ১৯৫৩ সালে ইরানে অভ্যুত্থানের পেছনে তেলের স্বার্থ ছিল, ব্রিটিশ মালিকানাধীন তেল কোম্পানিকে জাতীয়করণ করা হয়েছিল। প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের আগে যেসব যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ হতো, সেগুলোতে একটা জনপ্রিয় স্লোগান ছিল ‘তেলের জন্য রক্ত নয়’। ইরাক মূলত কুয়েতের তেল সম্পদের লোভেই প্রতিবেশী দেশ দখল করে নেয়। যুক্তরাষ্ট্র এবং মিত্রদের কুয়েতকে দখলমুক্ত করে নেয়ার মূলেও তেলের স্বার্থ ছিল। ২০০৩ সালের ২০ মার্চ শুরু হওয়া ইরাক যুদ্ধের পেছনে মূল কারণ ছিল ইরাকের বিপুল তেলসম্পদ। সিরিয়া আর ইরাকের যুদ্ধে বহুল আলোচিত ইসলামিক স্টেট সন্ত্রাসীদের আয়ের বড় উৎস ছিল তেলসম্পদ। ২০১৪ সালে ইসলামিক স্টেট প্রতিদিন দুই মিলিয়ন ডলারের তেল বিক্রি করত।
যে তেলের জন্য এতকিছু, সেই জ্বালানি তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী এখন
বিশ্ববাজারে। প্রতি ব্যারেল ৬০ ডলার হওয়া দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ
পর্যায়ের দাম। বিশ্বের বৃহত্তম দুই তেল উত্তোলক দেশ সৌদি আরব-ইরানের
কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব, পারমাণবিক চুক্তি ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান উত্তেজনা,
চীনে আমদানি বৃদ্ধির আগ্রহ, কাতারের সাথে সাতটি দেশের সম্পর্কচ্ছেদে তৈরি
সঙ্কট তথা মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতার সুযোগে বিশ্বে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে
দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। তেলের দাম নিয়ে নানা আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে; কেউ
বলছেন- ব্যারেল প্রতি তেলের দাম ৭০ ডলারে পৌঁছে যেতে পারে, কেউ বলছেন- ৩০০
ডলারেও পৌঁছতে পারে। আবার আবুধাবি পেট্রোলিয়াম এক্সিবিশন অ্যান্ড
কনফারেন্সে (এডিআইপিইসি) সবাই একমত যে, আগামী বছরও অপরিশোধিত তেলের দাম
ব্যারেল প্রতি ৬০ ডলারই থাকবে। ফলে আশা-নিরাশায় দুলছে তেলের বাজার, বিশ্ব
অর্থনীতিতে দেখা যাচ্ছে আশঙ্কার মেঘ।
অতিরিক্ত সরবরাহের চাপে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম অত্যাধিক কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বাজার নিয়ন্ত্রণে ওপেকসহ শীর্ষ উৎপাদকরা উৎপাদন কমিয়ে আনার ঘোষণা দেয়। এ সংক্রান্ত চুক্তির মেয়াদ ২০১৮ সালের মার্চে শেষ হবে। তবে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন বাড়ায় এ চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। চুক্তি নিয়ে ৩০ নভেম্বর ভিয়েনায় উৎপাদক দেশগুলোর বৈঠকে বসার কথা রয়েছে। বিশ্বের বৃহৎ তেল রফতানিকারক দেশগুলোর নেতাদের এই বৈঠকে সেখানে চুক্তির মেয়াদ আরো দীর্ঘায়িত করা নিয়ে ঘোষণা আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইনসহ বেশ কয়েকটি দেশ চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সৌদি যুবরাজকে তেল উৎপাদন কম রাখার চুক্তিটির মেয়াদ আরো বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন।
ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা-উদ্বেগের কারণে সবসময়ই মধ্যপ্রাচ্যে জ্বালানি তেলের বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক সমীকরণ নতুন দিকে যেভাবে মোড় নিচ্ছে, এই সঙ্কটময় পরিস্থিতি তেলের উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। তার প্রমাণ হচ্ছে- সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত বিদ্রোহীদের তেলসমৃদ্ধ দেইর এজ জোর অঞ্চল দখল করে রাখা, কুর্দিদের সাথে রাশিয়ার তেলের চুক্তি, বিশ্বের সর্বাধিক তেল উৎপাদনকারী দেশ সৌদি আরবে ব্যাপক ধরপাকড়, বাহরাইনের প্রধান তেলের পাইপলাইনে বিদ্রোহীদের বিস্ফোরণ ইত্যাদি। ইরাকের তেলসমৃদ্ধ অঞ্চল থেকে বিশ্বব্যাপী অপরিশোধিত জ্বালানি তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন তুরস্ক। অথচ ইরাকের উত্তরাঞ্চলে প্রস্তাবিত কুর্দিস্তান থেকে দৈনিক পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হয়। এ ছাড়া ইরাক-ইরান সীমান্তে ভয়াবহ ভূমিকম্পেও মধ্যপ্রাচ্যে তেলের উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাবই ফেলেছে।
একসময় বাজার চাঙা করার জন্য অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের সরবরাহ কমানো হয়েছে। অথচ এখন এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে যে- তেলের দাম দিন দিন কমে শূন্যের কোঠায় নেমে যাওয়ার প্রবণতা পরিবর্তিত হয়ে বাজারে ভারসাম্য ফিরে এসেছে। এমনকি দাম ক্রমাগত বাড়ার আশঙ্কায় তেল ব্যবহারকারী দেশগুলোর বিকল্প জ্বালানির দিকে ঝোকার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে; ইলেকট্রিক গাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনাও করছে তারা। তারপরও ১ নভেম্বর রয়টার্স পরিচালিত এক জরিপের উপর ভিত্তি করে ধারণা করা হচ্ছে, সৌদি আরব ডিসেম্বরে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম কমপক্ষে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করবে। সৌদি নেতৃত্বে ওপেকের ১১টি দেশ ১৯৮৬, ১৯৯০ ও ১৯৯৮ সালেও তেলের মূল্যের ‘খাড়াপতন’ অব্যাহত রেখেছিল। সৌদিরা প্রথম তেল-অস্ত্র ব্যবহার করেছিল ১৯৭৩ সালে। ২০০৮ সালে ব্যারেল প্রতি তেলের দাম ১৪৭ ডলার হয়েছিল।
সৌদি তৎপরতায় হুমকিতে মধ্যপ্রাচ্যের তেল উৎপাদন, বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এর প্রমাণ হচ্ছে- অতীতে প্রায়ই মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতার প্রভাব আন্তর্জাতিক তেলের বাজারে পড়তে দেখা গেলেও এবার তা হয়নি। রাজনৈতিক সঙ্কটে মধ্যপ্রাচ্য তেলের উৎপাদন কমিয়ে আনলে রেকর্ড পরিমাণ তেল উৎপাদন করে আন্তর্জাতিক বাজার স্থিতিশীল রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র, তেলের বাজারে মূল্যবৃদ্ধির সুবিধাও পাচ্ছে দেশটির তেল উৎপাদনকারীরা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রাকৃতিক তেল উৎপাদন রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি মধ্যপ্রাচ্যের তেলের বাজারের জন্য অশনি সঙ্কেত, ওপেক ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানের প্রমাণ। মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনাই যুক্তরাষ্ট্রের তেলের বাজারের সাফল্যের পেছনে কাজ করেছে। তেলের বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য মধ্যপ্রাচ্যের জন্য দুঃসংবাদ। দ্য ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি অ্যাজেন্সি (আইইএ) জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের তেলের উৎপাদন ২০২১ সাল নাগাদ ৫০ শতাংশ বাড়তে পারে। ২০২৫ সালে সৌদি আরবের তেলের উৎপাদনকে ছাড়িয়ে যাবে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তেল আমদানিকারক দেশ থেকে তেল রফতানিকারক দেশে পরিণত হবে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষক গ্রেগরি ব্রিউ জানান, যুক্তরাষ্ট্র তেল রফতানিকারক দেশ হলেও মধ্যপ্রাচ্য ও কানাডা থেকে আমদানি অব্যাহত রাখবে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের আমদানির ৩৬ শতাংশ সৌদি আরবের সৌদি আরামকো সরবরাহ করে। যুক্তরাষ্ট্রের তেলের উৎপাদন বাড়ানোর ফলে সৌদি নির্ভরতা কমবে। সৌদি আরব বাধ্য হবে আরো কম মূল্যে যুক্তরাষ্ট্রকে তেল সরবরাহ করতে। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ইরাক থেকেও তেল আমদানি করবে।
অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের তেলের বাজারে রাশিয়া প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। রাশিয়ার তেল কোম্পানি রজনেফট ভারত ও মিসরে কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ইরান সরকারের সাথে রাশিয়ার কয়েকটি কোম্পানি তেল ও গ্যাসক্ষেত্র সম্পর্কিত ছয়টি পৃথক চুক্তি করেছে। রুশ কোম্পানি রসনেফট কুর্দিস্তানের সবচেয়ে বড় তেলের পাইপলাইনের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। যে কাতার দৈনিক ছয় লাখ ২০ হাজার ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেল উত্তোলন করে, সেই কাতারকে নিয়ে সঙ্কট; ত্রুটির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ডাকোটায়ও কানাডার মধ্যবর্তী কিস্টোন পাইপলাইনে জ্বালানি তেল সরবরাহ বন্ধ থাকা ও প্রায় পাঁচ হাজার ব্যারেল জ্বালানি তেল ছড়িয়ে পড়াসহ নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা তেলের বাজারকে প্রভাবিত করেছে।
তেল রফতানিকারক দেশগুলোর সংগঠন অর্গানাইজেশন অব পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজের (ওপেক) দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ ইরাক। দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় কিরকুক প্রদেশ থেকে তুরস্কে অপরিশোধিত তেল রফতানির জন্য নতুন পাইপলাইন নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে বাগদাদ সরকার। তুরস্কের কেইহান বন্দরে পৌঁছানোর আগে এ পাইপলাইন ইরাকের সালাহউদ্দিন প্রদেশের বাইজি শহর পর্যন্ত বিস্তৃত করা হবে। সম্প্রতি ইরানের সাথেও একটি চুক্তি করেছে ইরাক, যার আওতায় কিরকুক থেকে প্রতিদিন তিন লাখ থেকে ছয় লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল ইরানের কেরমানশাহ শোধনাগারে পাঠানো হবে।
ইতোপূর্বে দাম বাড়াতে উৎপাদন কমানোর চুক্তিও করেছে তেল রফতানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেক।
ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা ছাড়াও তেলের দাম বাড়ে ক্রমবর্ধমান চাহিদা বৃদ্ধি পেলে, তেল রফতানিকারকরা উৎপাদন হ্রাসের সিদ্ধান্ত নিলে এবং তেল উৎপাদন স্থিতিশীল রাখলে। চাহিদা স্থিতিশীল থাকা ও মজুত কমার কারণে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি পেলেও তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি নির্ভর করে তেল উৎপাদক দেশগুলো উৎপাদন কতটা কমাবে তার ওপর।
News Link
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র জাপানে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ায় জাপান যুক্তরাষ্ট্রের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে পার্ল হারবারে আক্রমণ চালায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের তেলসমৃদ্ধ তলপেট দখল করাই ছিল জার্মানির অন্যতম লক্ষ্য। ১৯৫৩ সালে ইরানে অভ্যুত্থানের পেছনে তেলের স্বার্থ ছিল, ব্রিটিশ মালিকানাধীন তেল কোম্পানিকে জাতীয়করণ করা হয়েছিল। প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের আগে যেসব যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ হতো, সেগুলোতে একটা জনপ্রিয় স্লোগান ছিল ‘তেলের জন্য রক্ত নয়’। ইরাক মূলত কুয়েতের তেল সম্পদের লোভেই প্রতিবেশী দেশ দখল করে নেয়। যুক্তরাষ্ট্র এবং মিত্রদের কুয়েতকে দখলমুক্ত করে নেয়ার মূলেও তেলের স্বার্থ ছিল। ২০০৩ সালের ২০ মার্চ শুরু হওয়া ইরাক যুদ্ধের পেছনে মূল কারণ ছিল ইরাকের বিপুল তেলসম্পদ। সিরিয়া আর ইরাকের যুদ্ধে বহুল আলোচিত ইসলামিক স্টেট সন্ত্রাসীদের আয়ের বড় উৎস ছিল তেলসম্পদ। ২০১৪ সালে ইসলামিক স্টেট প্রতিদিন দুই মিলিয়ন ডলারের তেল বিক্রি করত।
অতিরিক্ত সরবরাহের চাপে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম অত্যাধিক কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বাজার নিয়ন্ত্রণে ওপেকসহ শীর্ষ উৎপাদকরা উৎপাদন কমিয়ে আনার ঘোষণা দেয়। এ সংক্রান্ত চুক্তির মেয়াদ ২০১৮ সালের মার্চে শেষ হবে। তবে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন বাড়ায় এ চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। চুক্তি নিয়ে ৩০ নভেম্বর ভিয়েনায় উৎপাদক দেশগুলোর বৈঠকে বসার কথা রয়েছে। বিশ্বের বৃহৎ তেল রফতানিকারক দেশগুলোর নেতাদের এই বৈঠকে সেখানে চুক্তির মেয়াদ আরো দীর্ঘায়িত করা নিয়ে ঘোষণা আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইনসহ বেশ কয়েকটি দেশ চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সৌদি যুবরাজকে তেল উৎপাদন কম রাখার চুক্তিটির মেয়াদ আরো বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন।
ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা-উদ্বেগের কারণে সবসময়ই মধ্যপ্রাচ্যে জ্বালানি তেলের বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক সমীকরণ নতুন দিকে যেভাবে মোড় নিচ্ছে, এই সঙ্কটময় পরিস্থিতি তেলের উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। তার প্রমাণ হচ্ছে- সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত বিদ্রোহীদের তেলসমৃদ্ধ দেইর এজ জোর অঞ্চল দখল করে রাখা, কুর্দিদের সাথে রাশিয়ার তেলের চুক্তি, বিশ্বের সর্বাধিক তেল উৎপাদনকারী দেশ সৌদি আরবে ব্যাপক ধরপাকড়, বাহরাইনের প্রধান তেলের পাইপলাইনে বিদ্রোহীদের বিস্ফোরণ ইত্যাদি। ইরাকের তেলসমৃদ্ধ অঞ্চল থেকে বিশ্বব্যাপী অপরিশোধিত জ্বালানি তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন তুরস্ক। অথচ ইরাকের উত্তরাঞ্চলে প্রস্তাবিত কুর্দিস্তান থেকে দৈনিক পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হয়। এ ছাড়া ইরাক-ইরান সীমান্তে ভয়াবহ ভূমিকম্পেও মধ্যপ্রাচ্যে তেলের উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাবই ফেলেছে।
একসময় বাজার চাঙা করার জন্য অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের সরবরাহ কমানো হয়েছে। অথচ এখন এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে যে- তেলের দাম দিন দিন কমে শূন্যের কোঠায় নেমে যাওয়ার প্রবণতা পরিবর্তিত হয়ে বাজারে ভারসাম্য ফিরে এসেছে। এমনকি দাম ক্রমাগত বাড়ার আশঙ্কায় তেল ব্যবহারকারী দেশগুলোর বিকল্প জ্বালানির দিকে ঝোকার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে; ইলেকট্রিক গাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনাও করছে তারা। তারপরও ১ নভেম্বর রয়টার্স পরিচালিত এক জরিপের উপর ভিত্তি করে ধারণা করা হচ্ছে, সৌদি আরব ডিসেম্বরে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম কমপক্ষে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করবে। সৌদি নেতৃত্বে ওপেকের ১১টি দেশ ১৯৮৬, ১৯৯০ ও ১৯৯৮ সালেও তেলের মূল্যের ‘খাড়াপতন’ অব্যাহত রেখেছিল। সৌদিরা প্রথম তেল-অস্ত্র ব্যবহার করেছিল ১৯৭৩ সালে। ২০০৮ সালে ব্যারেল প্রতি তেলের দাম ১৪৭ ডলার হয়েছিল।
সৌদি তৎপরতায় হুমকিতে মধ্যপ্রাচ্যের তেল উৎপাদন, বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এর প্রমাণ হচ্ছে- অতীতে প্রায়ই মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতার প্রভাব আন্তর্জাতিক তেলের বাজারে পড়তে দেখা গেলেও এবার তা হয়নি। রাজনৈতিক সঙ্কটে মধ্যপ্রাচ্য তেলের উৎপাদন কমিয়ে আনলে রেকর্ড পরিমাণ তেল উৎপাদন করে আন্তর্জাতিক বাজার স্থিতিশীল রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র, তেলের বাজারে মূল্যবৃদ্ধির সুবিধাও পাচ্ছে দেশটির তেল উৎপাদনকারীরা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রাকৃতিক তেল উৎপাদন রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি মধ্যপ্রাচ্যের তেলের বাজারের জন্য অশনি সঙ্কেত, ওপেক ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানের প্রমাণ। মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনাই যুক্তরাষ্ট্রের তেলের বাজারের সাফল্যের পেছনে কাজ করেছে। তেলের বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য মধ্যপ্রাচ্যের জন্য দুঃসংবাদ। দ্য ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি অ্যাজেন্সি (আইইএ) জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের তেলের উৎপাদন ২০২১ সাল নাগাদ ৫০ শতাংশ বাড়তে পারে। ২০২৫ সালে সৌদি আরবের তেলের উৎপাদনকে ছাড়িয়ে যাবে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তেল আমদানিকারক দেশ থেকে তেল রফতানিকারক দেশে পরিণত হবে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষক গ্রেগরি ব্রিউ জানান, যুক্তরাষ্ট্র তেল রফতানিকারক দেশ হলেও মধ্যপ্রাচ্য ও কানাডা থেকে আমদানি অব্যাহত রাখবে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের আমদানির ৩৬ শতাংশ সৌদি আরবের সৌদি আরামকো সরবরাহ করে। যুক্তরাষ্ট্রের তেলের উৎপাদন বাড়ানোর ফলে সৌদি নির্ভরতা কমবে। সৌদি আরব বাধ্য হবে আরো কম মূল্যে যুক্তরাষ্ট্রকে তেল সরবরাহ করতে। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ইরাক থেকেও তেল আমদানি করবে।
অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের তেলের বাজারে রাশিয়া প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। রাশিয়ার তেল কোম্পানি রজনেফট ভারত ও মিসরে কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ইরান সরকারের সাথে রাশিয়ার কয়েকটি কোম্পানি তেল ও গ্যাসক্ষেত্র সম্পর্কিত ছয়টি পৃথক চুক্তি করেছে। রুশ কোম্পানি রসনেফট কুর্দিস্তানের সবচেয়ে বড় তেলের পাইপলাইনের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। যে কাতার দৈনিক ছয় লাখ ২০ হাজার ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেল উত্তোলন করে, সেই কাতারকে নিয়ে সঙ্কট; ত্রুটির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ডাকোটায়ও কানাডার মধ্যবর্তী কিস্টোন পাইপলাইনে জ্বালানি তেল সরবরাহ বন্ধ থাকা ও প্রায় পাঁচ হাজার ব্যারেল জ্বালানি তেল ছড়িয়ে পড়াসহ নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা তেলের বাজারকে প্রভাবিত করেছে।
তেল রফতানিকারক দেশগুলোর সংগঠন অর্গানাইজেশন অব পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজের (ওপেক) দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ ইরাক। দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় কিরকুক প্রদেশ থেকে তুরস্কে অপরিশোধিত তেল রফতানির জন্য নতুন পাইপলাইন নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে বাগদাদ সরকার। তুরস্কের কেইহান বন্দরে পৌঁছানোর আগে এ পাইপলাইন ইরাকের সালাহউদ্দিন প্রদেশের বাইজি শহর পর্যন্ত বিস্তৃত করা হবে। সম্প্রতি ইরানের সাথেও একটি চুক্তি করেছে ইরাক, যার আওতায় কিরকুক থেকে প্রতিদিন তিন লাখ থেকে ছয় লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল ইরানের কেরমানশাহ শোধনাগারে পাঠানো হবে।
ইতোপূর্বে দাম বাড়াতে উৎপাদন কমানোর চুক্তিও করেছে তেল রফতানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেক।
ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা ছাড়াও তেলের দাম বাড়ে ক্রমবর্ধমান চাহিদা বৃদ্ধি পেলে, তেল রফতানিকারকরা উৎপাদন হ্রাসের সিদ্ধান্ত নিলে এবং তেল উৎপাদন স্থিতিশীল রাখলে। চাহিদা স্থিতিশীল থাকা ও মজুত কমার কারণে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি পেলেও তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি নির্ভর করে তেল উৎপাদক দেশগুলো উৎপাদন কতটা কমাবে তার ওপর।
News Link

No comments