Header Ads

Header ADS

সিরিয়া সংকট :একটি মূল্যায়ন

ড. মো. আবদুল্লাহ হেল কাফী
সিরিয়ার সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যসহ আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপকভাবে সাড়া ফেলেছে। সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির এই সুযোগকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আজ পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশসমূহ, ইসরাইল এবং তুরস্কের মতো দেশগুলো সিরিয়ার উপর নিজেদের কর্তৃত্ব নিশ্চিত করার ব্যাপারে তত্পর। সিরিয়াতে চলমান অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে একদিকে যেমন দেশটিতে সন্ত্রাসবাদের উত্থান ঘটেছে তেমনি আবার পশ্চিমা শক্তিবর্গের স্বার্থসিদ্ধির তত্পরতাও বেড়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ এরূপ রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে সীমান্ত এলাকায় যে সন্ত্রাসবাদের উত্থান ঘটেছে তার প্রতিফলন হিসেবে তুরস্ক নিজ নিরাপত্তার স্বার্থে বাসার-আল আসাদের পতনের লক্ষ্যে সিরিয়ার সাথে যে যুদ্ধে জড়াবে না তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। অতিসম্প্রতি তুরস্কের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেন যে, তুরস্ক যুদ্ধ চায় না। কিন্তু দেশটি সিরিয়ার সাথে যুদ্ধে যাওয়ার খুব কাছাকাছি অবস্থায় আছে। ২০১১ সালে সিরিয়াতে যে রাজনৈতিক উত্থান শুরু হয়েছে তার পিছনে তুরস্কের অবদান অনেকখানি। মূলত তুরস্ক নিজ জাতি ও স্বার্থগত কারণে বাসার-আল আসাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিদ্রোহীদেরকে সহযোগিতা প্রদান করে যাচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিক ও সামরিক কারণে তুরস্ক সিরিয়ার সাথে সরাসরি যুদ্ধে নাও যেতে পারে। এর মূল কারণ হচ্ছে আন্তর্জাতিক সমর্থন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সিরিয়াতে যে সন্ত্রাসবাদের উত্থান ঘটেছে তা তুরস্কের জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে কতটুকু হুমকির মুখে নিয়ে যেতে পারে তার উপর নির্ভর করছে তুরস্ক কর্তৃক সিরিয়ার বিরুদ্ধে আগ্রাসন, কেননা তুরস্ক এককভাবে সিরিয়ার সাথে জড়াবে না। তাই ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলোর কাছ থেকে সমর্থন নিয়ে তুরস্ক সিরিয়ার সাথে যুদ্ধে যেতে চায়। কিন্তু তুরস্ক সিরিয়ার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভের ব্যাপারে হতাশ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সিরিয়ার সাথে যুদ্ধে যাওয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য ইউরোপীয়ান দেশগুলো ততটা আগ্রহী না। সিরিয়ার সাথে রাশিয়া, চীন, ইরাক এবং ইরানের সম্পর্ক বেশ ভাল। নি:সন্দেহে তুরস্ক একটি আঞ্চলিক শক্তি কিন্তু তেল আমদানির ক্ষেত্রে দেশটি সম্পূর্ণভাবে রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশ-গুলোতে যে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে তা শুধু যে মধ্যপ্রাচ্যকেই প্রভাবিত করেছে তা নয় বরং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এর কম-বেশি প্রভাব রয়েছে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে তুরস্ক-রাশিয়া সম্পর্কের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে সাম্প্রতিককালে রাশিয়া এবং তুরস্কের মতামত ও জাতীয় নীতি-নির্ধারণ প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভিন্নতা দেখতে করতে পাই। আর সিরিয়া সংকট আঙ্কারা এবং মস্কোর মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গীর ভিন্নতার মাত্রা বাড়িয়েছে অনেকখানি। মধ্যপ্রাচ্য ব্যাপারে রাশিয়া এবং তুরস্কের মূলনীতি প্রায় একই। তা হলো আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা। উভয় দেশই মধ্যপ্রাচ্যে ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন এবং মার্কিন সৈন্যের অবস্থান নিয়ন্ত্রণ তথা হরাস করার ব্যাপারে তত্পর। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণ করলে রাশিয়া এবং তুরস্ক উভয়েই এরূপ আক্রমণের সমালোচনা করেন।

ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে সিরিয়া তুরস্ক এবং রাশিয়া উভয়ের কাছেই বেশ গুরুত্ব বহন করে। তাই সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলে তা মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য অঞ্চলের দেশগুলোতে প্রভাব ফেলবে এটাই স্বাভাবিক। তুরস্ক এবং রাশিয়া উভয়েই সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ সংকট নিরসনে তত্পর। যদিও তাদের দৃষ্টিভঙ্গীগত পার্থক্য রয়েছে তুরস্ক সংকটের প্রেক্ষাপট ও ভবিষ্যত্ নিয়ে। তুরস্ক এবং সিরিয়া হচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র আর রাশিয়ার অবস্থান ভৌগোলিক মানচিত্রে সিরিয়া থেকে অনেক দূরে। অর্থাত্ সিরিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে কোন সীমান্ত সংযোগ নেই। কিন্তু অর্থনৈতিক ও কৌশলগত দিক থেকে রাশিয়ার কাছে সিরিয়ার গুরুত্ব বেশি। তাছাড়া বাসার-আল আসাদের সাথে রাশিয়ার বর্তমান সরকারের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ভাল হওয়ার কারণে আসাদকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে রাশিয়া সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্কের সাথে সিরিয়া জটিল এক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে আবদ্ধ। ১৯৯০ সাল থেকে তুরস্ক-সিরিয়া সম্পর্ক ক্রমেই খারাপের দিকে ধাবিত হতে থাকে। যখন তুরস্ক ঘোষণা করে যে, যদি পি.কে.কে. নেতা আব্দুল্লাহ ওকালনকে মুক্তি না দেয়া হয় এবং যদি কুর্দি সামরিক শক্তির উপর থেকে দামেস্কর সমর্থন না সরিয়ে নেয়া হয় তাহলে তুরস্ক সিরিয়ার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে। এসব রাজনৈতিক জটিলতার পাশাপাশি বাণিজ্যিক এবং কৌশলগত দিক থেকে তুরস্ক এবং সিরিয়া উভয়েই একে অপরের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ২০১০ সাল নাগাদ তুরস্ক কর্তৃক সিরিয়াতে রপ্তানি বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১.৮ বিলিয়ন ডলার। আবার কৌশলগত দিক থেকে তুরস্কের কাছে সিরিয়া বেশ তাত্পর্য বহন করে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নিজের বাণিজ্য টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে তুরস্ক অনেক ক্ষেত্রেই সিরিয়াকে ট্রানজিট করিডোর হিসেবে ব্যবহার করে আসছে।

অন্যদিকে বাণিজ্যিক দিক থেকে সিরিয়া এবং রাশিয়ার সম্পর্ক বেশ নিবিড়। রাশিয়া সিরিয়াতে প্রচুর সামরিক অস্ত্র রপ্তানি করে থাকে। তাছাড়া সিরিয়ার টারটোয়াস বন্দরে রাশিয়ার নৌ-ঘাঁটি রয়েছে। সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে রাশিয়ার কাছে সিরিয়া তাই কৌশলগত দিক থেকে তাত্পর্যপূর্ণ।

তাই সিরিয়ার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা তুরস্ক এবং রাশিয়া উভয় দেশেরই একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু ২০১১ সালে সিরিয়াতে যে রাজনৈতিক উত্থান শুরু হয়েছে সে বিষয়ে রাশিয়া এবং তুরস্ক দুটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী থেকে নিজেদের সমর্থন দিয়েছে। তুরস্ক মূলত আসাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিদ্রোহীদের সমর্থন করে যাচ্ছে। অন্যদিকে রাশিয়া সিরিয়ায় চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রসঙ্গে তুরস্ক এবং পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক আরোপিত অবরোধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে রাশিয়া। এমনকি সিরিয়ার টারটোয়াস বন্দরে রাশিয়া নিজ দেশের যুদ্ধ জাহাজ পাঠিয়েছে মূলত সিরিয়ার প্রতি রাশিয়ার অটুট সমর্থনের বহি:প্র্রকাশ হিসেবে। সিরিয়ায় চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য রাশিয়া বিদ্রোহীদের দায়ী করেছে এবং এরূপ রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রশমনের জন্য সরকারি ও বিরোধী গ্রুপগুলোর মধ্যে সংলাপের আয়োজন করার উপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছে রাশিয়া। রাশিয়া কর্তৃক আসাদকে এরূপ সমর্থন দানের পেছনে মূলত তিনটি অন্যতম কারণ রয়েছে-অস্ত্র শিল্প, বাণিজ্যিক সম্পর্ক, টারটোয়াস বন্দরে রাশিয়ান নৌ-ঘাঁটি। স্বাভাবিকভাবে অস্ত্র ব্যবসায়ের জন্য যুদ্ধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০১১ সাল নাগাদ রাশিয়ান অস্ত্র ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো আনুমানিক এক বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের অস্ত্র সিরিয়ায় বিক্রি করেছে। অন্যদিকে অস্ত্র ছাড়াও অন্যান্য ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে রাশিয়ার কাছে সিরিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সিরিয়া রাশিয়া থেকে প্রচুর পরিমাণে পেট্রোলিয়াম জাতীয় দ্রব্য, ইলেক্ট্রনিক্স দ্রব্যসহ আরো অন্যান্য দ্রব্য সামগ্রী আমদানি করে থাকে। ২০১১ সাল নাগাদ রাশিয়া এবং সিরিয়ার মধ্যে মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১.৯৭ বিলিয়ন ডলার। আবার সিরিয়ার টারটোয়াস বন্দরে রাশিয়া যে নৌ-ঘাঁটি স্থাপন করেছে তা সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার প্রভাব বজায় রাখার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই যদি সিরিয়াতে পশ্চিমা শক্তির সমর্থন নিয়ে অন্য কোন সরকার ক্ষমতায় আসে তাহলে হয়তো তা রাশিয়ার জাতীয় স্বার্থের জন্য হানিকারক হতে পারে। আর তাই রাশিয়া বাসার-আল আসাদের উপর নিজের সমর্থন রাখার ব্যাপারে অনড়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা হলো রাশিয়ার কূটনৈতিক নীতির অন্যতম উদ্দেশ্য। সিরিয়াতে সরকার পরিবর্তন রাশিয়ার জাতীয় স্বার্থের জন্য হানিকর হতে পারে। আর এটা ভেবেই হয়তো যদি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সিরিয়াতে আন্তর্জাতিক সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়ে কোন আদেশ জারি করা হয় তাহলে হয়তো রাশিয়া তাতে ভেটো দিতে পারে।

সিরিয়ার এরূপ অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে যে প্রশ্নটা বার বার আমাদের সামনে উঠে আসে তা হলো-প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাসার-আল আসাদ কি শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পারবে? সাম্প্রতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যেতে পারে, হয়তো পারবেন। কেননা এখনো আসাদকে প্রতিহত করার মতো শক্তির উত্থান সিরিয়াতে হয়নি। সিরিয়ার বিদ্রোহী গ্রুপগুলো এবং পশ্চিমা নেতৃবৃন্দ মনে করছেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে বাসার-আল আসাদ সরকারের পতন হতে পারে। আসাদের সরকার সিরিয়াতে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পারবেন কি-না তা মূলত চারটি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। আর এগুলো হলো বাসার-আল আসাদের সামরিক শক্তি ও গ্রহণযোগ্যতা, বিরোধী গ্রুপগুলোর দুর্বলতা, সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ এই সংকটে বিদেশি শক্তি কর্তৃক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা এবং সবশেষে পশ্চিমা শক্তি ও জাতিসংঘ কর্তৃক অর্থনৈতিক ও অন্যান্য অবরোধ আরোপের প্রভাব।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও সাবেক বিভাগীয় সভাপতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
News link

No comments

Powered by Blogger.