Header Ads

Header ADS

কাতালোনিয়ার সংকট ও ইউরোপের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন

কাতালোনিয়ার সংকট ইউরোপকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? এ প্রশ্ন এখন ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে কাতালোনিয়ায় স্পেনের কেন্দ্রীয় শাসন জারি করার পর। গত এক মাসে কাতালোনিয়া নিয়ে সংকট বেড়েছে। এ সংকট শুধু স্পেন-কাতালোনিয়া দ্বন্দ্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। এ সংকট ইউরোপের অন্যান্য দেশকেও স্পর্শ করেছে। আমি গত সপ্তাহে ইউরোপে ছিলাম। ফ্রান্স, জার্মানি, চেক রিপাবলিক—যেখানেই আমি গেছি, সেখানেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হতে দেখেছি। আলোচনা হয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। আলোচনা হয়েছে টিভিতে। এ আলোচনা যে অব্যাহত থাকবে, তা বলাই বাহুল্য।
কাতালোনিয়া স্পেনের একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ। জনসংখ্যা মোট ৭৫ লাখ। স্পেনের মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ বাস করে এই কাতালোনিয়ায়। অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী এই প্রদেশ। প্রদেশের রাজধানী বার্সেলোনা। কাতালোনিয়ার রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। বার্সেলোনার ফুটবল টিম বিশ্ববিখ্যাত। স্পেনের মোট জিডিপির পাঁচ ভাগের এক ভাগ আসে এই প্রদেশ থেকে। ২০০৬ সালে প্রণীত একটি আইন অনুযায়ী কাতালোনিয়া যথেষ্ট স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে। তাদের আলাদা ‘জাতি’ হিসেবেও স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কাতালোনিয়ায় এর আগে যে প্রাদেশিক সরকার ছিল, তারা ২০১৫ সালে ক্ষমতায় এসেছিল ‘স্বাধীনতা’ দাবি করে। গেল সেপ্টেম্বর মাসে সেখানে গণভোট অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে স্বাধীনতার পক্ষে রায় পড়ে। এবং কাতালোনিয়ার পার্লামেন্ট তা অনুমোদন করে। এর মধ্য দিয়ে কাতালোনিয়ার সঙ্গে কেন্দ্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। গণভোটে স্বাধীনতার পক্ষে রায় পাওয়ার পর থেকেই কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা কার্লেস পুজদেমন বলে আসছিলেন গণভোটের রায়ের প্রতি সম্মান দেখিয়ে তিনি কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। কিন্তু স্বাধীনতা ঘোষণার আগেই স্পেনের প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রাজয় কাতালোনিয়ার প্রাদেশিক সরকারকে বরখাস্ত করে সেখানে কেন্দ্রের শাসন জারি করেন। স্পেনের উপপ্রধানমন্ত্রীকে এখন কাতালোনিয়ার নির্বাহী প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরে সেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু এই নির্বাচন কি আদৌ সেখানে কোনো পরিবর্তন ডেকে আনতে পারবে? অর্থাৎ স্বাধীনতার পক্ষে সেখানে যে জনমত রয়েছে, সেই জনমত কি আবারও স্বাধীনতাকামীদের নির্বাচিত করবে, নাকি যাঁরা স্বাধীনতা চান না, তাঁদের ক্ষমতায় পাঠাবে? স্পেনের উপপ্রধানমন্ত্রী সোরাইয়া সান্তামারিয়ার ভূমিকাই বা কী হবে এখন? তিনি এখন কাতালোনিয়ার শাসক। স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার নিশ্চয়ই চাইবে কাতালোনিয়া স্পেনের সঙ্গেই থাকুক। কিন্তু কার্লেস পুজদেমনের নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতাকামীরা নির্বাচনে কি ফলাফল বয়ে আনতে পারবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে এটা সত্য, কাতালোনিয়ার এই স্বাধীনতা আন্দোলন ইউরোপের অন্যত্র তেমন কোনো আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এটা সমর্থন করেনি। এমনকি ইউরোপের কোনো রাজনৈতিক দলও কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়ায়নি। এটাই হচ্ছে কাতালোনিয়ার স্বাধীনতাকামীদের বড় ব্যর্থতা। তবে এটা সত্য, কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলন এখন ইউরোপের অন্যত্র বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। এই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হবে ইউরোপের অন্যান্য বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন। এসব বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের খবর আমরা এখানে উল্লেখ করতে পারি। ক্রোয়েশিয়ার (সাবেক যুগোস্লাভিয়া) ইসত্রিয়ার (Istria) কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯৯১ সালে ক্রোয়েশিয়া স্বাধীন হয়ে যায়। ক্রোয়েশিয়া ও স্লোভেনিয়ার মধ্যবর্তী অঞ্চল হচ্ছে ইসত্রিয়া। ইসত্রিয়া ডেমোক্রেটিক অ্যাসেম্বলি (Istrian Democratic Assembly Party- IDS) পার্টি এখন ইসত্রিয়ার স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন করছে, যা কিনা নতুন একটি রাষ্ট্রের জন্ম দিতে পারে ভবিষ্যতে। চেক রিপাবলিকের দুটি অঞ্চল—মোরাভিয়া ও চেক সিলোসিয়া। মোরাভিয়া (জনসংখ্যা ৩০ লাখ, চেক রিপাবলিকের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ) ঐতিহাসিকভাবেই আলাদা একটি অঞ্চল। তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রয়েছে। ২০০৫ সাল থেকেই মোরাভিয়া নিজস্ব পার্লামেন্ট ও অধিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানিয়ে আসছে। অন্যদিকে ১০ লাখ (১০ শতাংশ) অধিবাসী অধ্যুষিত চেক সিলোসিয়া কিংবা আপার সিলোসিয়ার (জনসংখ্যা ৩০ লাখ, ৭.৮ শতাংশ) আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তবে সমস্যা হচ্ছে আপার সিলোসিয়ার একটি অংশ পোল্যান্ড ও একটি অংশ জার্মানিতে রয়েছে। পোল্যান্ডের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত অংশটি স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন করছে। ২০১১ সাল থেকে সিলোসিয়ান অটোনমি মুভমেন্ট (আরএএম) এই স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন করে আসছে। পোল্যান্ড, চেক রিপাবলিক আর জার্মানিতে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বসবাসরত সিলোসিয়ানরা ভবিষ্যতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে, অনেকটা কাতালোনিয়ার স্টাইলে। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন জারজি গোরজেলিক। রুমানিয়ার একটি অঞ্চল সেজকেলি ল্যান্ড (Szekely Land)। এখানে বসবাসকারী জাতিগতভাবে হাঙ্গেরিয়ান নাগরিকরা বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। স্কটল্যান্ডের একটি ছোট্ট দ্বীপপুঞ্জ, নাম বর্নহোলম (Bornholm), জনসংখ্যা মাত্র ৪০ হাজার, দীর্ঘদিন তারা অধিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। ডেনমার্কের ফারোও (Faroe) দ্বীপপুঞ্জের স্বায়ত্তশাসন (লোকসংখ্যা ৫০ হাজার) আন্দোলনের খবরও আমরা জানি। মূল ভূখণ্ড থেকে ৫৬০ মাইল দূরে অবস্থিত ফারোও দ্বীপপুঞ্জের আলাদা সংস্কৃতি ও ভাষাগত বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তারা পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। ইতালির সবচেয়ে সমৃদ্ধ অঞ্চল হচ্ছে লমবারদি (Lombardy)। লোকসংখ্যা এক কোটি। এ এলাকার জনগোষ্ঠীর বড় অভিযোগ হচ্ছে তারা যে ট্যাক্স দেয়, তা তাদের উন্নয়নে রাষ্ট্র ব্যয় করে না, ব্যয় করে দক্ষিণের অপেক্ষাকৃত গরিব অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য। তাই তারা আন্দোলন করছে অনেকটা ‘কাতালোনিয়ান’ স্টাইলে অধিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য। তাদের আন্দোলনের সঙ্গে যোগ দিয়েছে ভেনেতোর অধিবাসীরা (লোকসংখ্যা ৫০ লাখ)। সিসিলির স্বাধীনতা আন্দোলনের খবরও আছে। সিসিলি ইতালির একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। এদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষা ইতালির মূলধারা থেকে পৃথক। সেখানে স্বাধীনতাকামীরা যথেষ্ট সক্রিয়। দক্ষিণ তিরল (South Tyrol)-এর অবস্থাও তেমনই। দক্ষিণ তিরলের অধিবাসীরা জার্মান ভাষায় কথা বলে এবং ইতালির সঙ্গে তাদের সংস্কৃতিগত অনেক পার্থক্য রয়েছে। বাস্ক স্বাধীনতা আন্দোলনের খবর তো অনেকেই জানেন। বাস্ক (স্পেন) বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ২০১১ সালের পর কমে গেলেও সেখানে (জনসংখ্যা ৩০ লাখ, স্পেনের মোট জনগোষ্ঠীর ৪.৬ শতাংশ) বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তাধারা অত্যন্ত শক্তিশালী। এসব অঞ্চলের পাশাপাশি করসিকা (Corsica) স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের খবর সাম্প্রতিককালে সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। করসিকার স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে Pe a Corsica, ২০১৫ সালের স্থানীয় নির্বাচনে ৫১টি আসনের মধ্যে ২৪টি আসন পেয়েছিল। পশ্চিম ইউরোপে ফ্লানডার্স (Flanders, হল্যান্ড, জনসংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ), ওয়ালোনিয়া (Wallonia, বেলজিয়াম, লোকসংখ্যা ৩৬ লাখ), বেভেরিয়া (Bavaria, জার্মানি, লোকসংখ্যা এক কোটি ২৯ লাখ), নর্দান আয়ারল্যান্ড (Northern Ireland, যুক্তরাজ্য, জনসংখ্যা ১৮ লাখ), কিংবা স্কটল্যান্ড (জনসংখ্যা ৫৪ লাখ), ওয়েলসের (জনসংখ্যা ৩১ লাখ) স্বাধীনতা তথা অধিক স্বায়ত্তশাসনের খবর আমরা জানি। এর অর্থ হচ্ছে, আজ যদি কাতালোনিয়া স্পেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে ভবিষ্যতে এ ধরনের আরো অনেক কাতালোনিয়ার জন্ম হবে ইউরোপে। অর্থাৎ অনেক অঞ্চল তাদের স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, ভাষাগত ভিন্নতার কারণে মূল দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চাইবে। ইউরোপের ঐক্যের জন্য তা হবে দুঃসংবাদ।
কাতালোনিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে বলা মুশকিল। তবে এটা সত্য, স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার একটি ‘শক্ত’ অবস্থানে গেছে। কাতালোনিয়ার সরকারকে বরখাস্ত করার পর ২৭ অক্টোবর বার্সেলোনায় ঐক্যবদ্ধ স্পেনের পক্ষে বড় ধরনের মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা কেউ কেউ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নেতা কার্লেস পুজদেমনের গ্রেপ্তারেরও দাবি জানিয়েছে। পরিস্থিতি সেখানে যে খুব স্বাভাবিক, তা বলা যাবে না। কেননা পুজদেমন বলছেন, তিনি তাঁর সরকারের বরখাস্ত ও কাতালোনিয়ায় কেন্দ্রের শাসনকে স্বীকার করেন না। কাতালোনিয়ার বরখাস্তকৃত সরকারের ডেপুটি প্রেসিডেন্ট অরিয়ল জুনকুয়েরাজ কাতালোনিয়ার সংবাদপত্র EI Punt Avui-এ লিখেছেন, ‘কাতালোনিয়া রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে কার্লেস পুজদেমন এখনো বহাল আছেন। আমরা কাতালোনিয়া সরকারের বিরুদ্ধে যে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে, তা মানি না।’ এর অর্থ পরিষ্কার, কাতালোনিয়ায় একদিকে যেমন রয়েছে স্বাধীনতাকামীরা, অন্যদিকে তেমনি রয়েছে স্বাধীনতাবিরোধীরাও।
শুক্রবারের মিছিলে অংশ নিয়েছিল কয়েক হাজার মানুষ। তারা ঐক্যবদ্ধ স্পেনের স্লোগান দিয়েছে। সুতরাং প্রশ্ন থেকেই গেল—কাতালোনিয়ার ভবিষ্যৎ তাহলে কী? স্পেনের জনসংখ্যার যেখানে ১৬ শতাংশ মানুষ বাস করে কাতালোনিয়ায়, স্পেনের জিডিপির ১৯ শতাংশ যেখানে আসে কাতালোনিয়া থেকে, সে ক্ষেত্রে স্বাধীন দেশ হিসেবে কাতালোনিয়ার সম্ভাবনা কতটুকূ? এ প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। কেননা কাতালোনিয়া অদূর ভবিষ্যতে স্পেনের নাগপাশ থেকে বেরিয়ে গেলেও ইইউতে থাকা, না থাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। ব্রিটেনের কথা অনেকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। ব্রিটেনের ব্রেক্সিটের পর এখন ব্রিটেনকে প্রচুর অর্থ দিতে হচ্ছে ইইউকে। কাতালোনিয়া তা পারবে না। তবে এটা অনেকে স্বীকার করে, কাতালোনিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ইউরোপের অনেক বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে এখন উৎসাহ জোগাবে। সে ক্ষেত্রে এক ‘নতুন ইউরোপ’কে আমরা দেখতে পাব আগামী দিনগুলোতে।
লেখক : অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
tsrahman09@gmail.com

News Source

No comments

Powered by Blogger.