Header Ads

Header ADS

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও কার্যের ভারসাম্য: স্বশাসন ও সুশাসনের জন্য বিকেন্দ্রীকরণ

রাজনীতি বিজ্ঞানের সনাতনী ও ধ্রুপদী আলোচনায় রাষ্ট্রের মূল তিনটি অঙ্গ তথা আইন, শাসন ও বিচার বিভাগের মধ্যে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টভাবে ক্ষমতা বিভাজনের বিধান যেমন স্বীকৃত, তেমনিভাবে পারস্পরিক সম্পূরক ও পরিপূরক সম্পর্ক বিবেচনায় ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থারও বিভিন্ন রূপ ও কাঠামো বিদ্যমান। এভাবে আইন বিভাগ আইন প্রণয়ন (Law making), শাসন বিভাগ আইনের বাস্তবায়ন (Execution) এবং বিচার বিভাগ আইনি প্রতিবিধান ও আইনের ব্যাখ্যা (Adjudication) প্রদানের জন্য সংবিধান নির্দেশিত পথে স্ব স্ব অধিক্ষেত্রের মধ্যেই আরোপিত কার্যাদি সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতার অধিকারী হয়। এটি বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ এবং কার্যাদি সম্পাদনের ধ্রুপদী চিত্র। তবে চিত্রটি বিশ্বের সর্বত্রই একই রকম নয়। দেখা যায়, ক্ষমতা পৃথকীকরণের সাংবিধানিক অঙ্গীকার থাকা সত্ত্বেও তিনটি অঙ্গের বিভাজন রেখার প্রতি সম্মান রেখে ক্ষমতা প্রয়োগে ‘ভারসাম্য’ প্রায়ই বিঘ্নিত হয়। এজন্য দেশে দেশে দর্শনগত দিক থেকে অধিকতর ‘গণতন্ত্রায়ন’ (তথা স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, জনসম্পৃক্ততা) এবং গণতন্ত্রের চর্চা ও জনসম্পৃক্ততার নীতিকে অধিকতর কার্যকর করার উপায় হিসেবে এবং আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য গণতন্ত্রের বাস্তব প্রায়োগিক সাফল্যের কৌশল হিসেবে ‘বিকেন্দ্রায়ন’ বা ‘বিকেন্দ্রীকরণ’কে একটি শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবিধান হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
বিকেন্দ্রায়নের বৃহত্তর যৌক্তিকতা: বিকেন্দ্রীকরণের উদ্দেশ্যের নিরিখে এর যৌক্তিকতাকে নিম্নলিখিত কয়েকটি প্রধান দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা যেতে পারে:
১. ক্ষমতার ভারসাম্যের জন্য বিকেন্দ্রীকরণ (এখানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী, ভৌগোলিক-আঞ্চলিক বিভিন্নতা ও পশ্চাত্পদতা ইত্যাদি বিবেচনা করা হয়); ২. অধিকতর গণতন্ত্রায়নের জন্য বিকেন্দ্রীকরণ; ৩. সমতা ও জনমুখী সেবার জন্য বিকেন্দ্রীকরণ; ৪. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্য বিকেন্দ্রীকরণ; ৫. জনসম্পৃক্ততা, সমতায়ন ও গণক্ষমতায়নের জন্য বিকেন্দ্রীকরণ; ৬. স্বশাসন ও সুশাসনের জন্য বিকেন্দ্রীকরণ এবং ৭. প্রশাসনিক ও অর্থব্যবস্থার দক্ষতার জন্য বিকেন্দ্রীকরণ।
বিশ্বে উল্লিখিত সাতটি যৌক্তিকতার যেকোনো এক বা একাধিক অথবা সম্মিলিতভাবে সবগুলো সামনে রেখেই বিকেন্দ্রীকরণ নীতি প্রণীত হতে দেখা যায়।
বিকেন্দ্রীকরণ কী: বিকেন্দ্রীকরণের বহুতর সংজ্ঞা বিদ্যমান। বেশির ভাগ সংজ্ঞায় দেখা যায়, ওপর থেকে নিচে ক্ষমতার প্রবাহ হস্তান্তর বা স্থানান্তরকে বিকেন্দ্রীকরণ বোঝানো হয়। বাস্তব প্রায়োগিক অভিজ্ঞতায় তা সম্পূর্ণ সঠিক নয়। ‘ক্ষমতা’ (power), কর্তৃত্ব (authority), কখনো ‘সম্প্রদান কারক’ নয়। স্বত্ব ত্যাগ করে কোথাও কেউ ক্ষমতা দিয়ে দেয় না। ক্ষমতার সম্প্রসারণ, বিকাশ ও ভাগাভাগি হয় মাত্র। বিকেন্দ্রায়ন ক্ষমতা-সম্পর্কের একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করে এবং ক্ষমতার কেন্দ্রের সংখ্যা ও ব্যাপ্তি বাড়িয়ে দেয়। চূড়ান্ত বিকেন্দ্রীকরণ বলে বাস্তবে কোনো ব্যবস্থা নেই। এটি একটি প্রক্রিয়া, যার কোনো সর্বশেষ বা সমাপ্তি বিন্দু নেই। এর শুরুর বিন্দু আছে ঠিকই, এটি ক্রমাগত প্রসারণশীল। কারণ মানুষের ক্ষমতা ও সৃজনশীলতার কোনো শেষ নেই। এটি একটি অব্যাহত প্রক্রিয়া। অনেকে আবার ‘বিকেন্দ্রীকরণ’-এর স্থলে ‘বিকেন্দ্রায়ন’ প্রত্যয় ব্যবহারকে বেশি পছন্দ করেন। তাতে তার চলমানতা ও গতিশীলতাকে সঠিকভাবে ধারণা করা যায়।
ক্ষমতা কী: ক্ষমতার প্রয়োজন ও প্রয়োগের স্বরূপ কেমন হয় বা হবে— এটি একটি অত্যন্ত মৌলিক প্রশ্ন। আনুষ্ঠানিক ক্ষমতার সঙ্গে ‘বৈধ বল প্রয়োগ’-এর বা বাধ্যবাধকতার একটি সম্পর্ক যেমন থাকে, তেমনি থাকে স্বাভাবিক, স্বতঃস্ফূর্ত বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে আরোপিত, অর্জিত বৈধতা এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা। ইংরেজিতে ‘পাওয়ার’ ও ‘অথরিটি’ দুটি শব্দ জড়াজড়িভাবে কিংবা পৃথকভাবে ব্যবহার হয়। পাওয়ার প্রায়ই আইনগত বৈধতা এবং অথরিটি আইনের বাইরেও বিষয় ও বৈষয়ী বৈধতা নির্দেশক। আইন বা বিধি বা বিধিসম্মতভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত না হয়েও আইনের একজন পণ্ডিত বা আইনজ্ঞের ব্যাখ্যার গ্রহণযোগ্যতা থাকতে পারে। কিন্তু প্রচলিত আদালতের ব্যাখ্যার আইনি বাধ্যবাধকতা ও গ্রহণযোগ্যতা ভিন্নভাবে দেখতে হবে। পণ্ডিতের ব্যাখ্যা প্রয়োগযোগ্য হবে না। কিন্তু ফেলে দেয়াও যায় না। একটি বিকেন্দ্রায়িত সমাজের উভয়ের গুরুত্ব থাকে এবং তাতে সর্বক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষিত হয়।
বাংলাদেশ প্রাচীন জাতির নবীন রাষ্ট্র: বাঙালি একটি প্রাচীন জাতি, কিন্তু বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্র কাঠামোটি অপেক্ষাকৃত নবীন। এ জাতির অস্থিমজ্জায় ও মন-মস্তিষ্কে গণতান্ত্রিক চেতনা, আত্মপ্রকাশের দুর্বার আকাঙ্ক্ষা। বলা, লেখা ও চিন্তার স্বাধীনতা তার শ্বাস-প্রশ্বাসের বায়ু এবং বেঁচে থাকার আয়ুর সঙ্গে একাকার। কিন্তু একটি নবীন রাষ্ট্র হিসেবে এর সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এখনো ভঙ্গুরতা (fragility) ও স্পর্শকাতরতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাই এ রাষ্ট্র সর্বদা নানামুখী শঙ্কা, সন্দেহ ও ভয়ে সংকুচিত হয়ে থাকে। তাই এখানে ক্ষমতা ও কার্যের সংকোচন ও প্রসারণ একটি বাস্তব দ্বান্দ্বিকতা। এ দ্বান্দ্বিকতা অপরিহার্য ও অনস্বীকার্য এবং দ্বান্দ্বিকতাকে গভীরভাবে উপলব্ধির মধ্যেই রয়েছে পরস্পরবিরোধী এ অভিঘাতের সৃজনশীল বিকাশ। এ দ্বান্দ্বিকতার বিকাশের মধ্যে নিহিত গণতন্ত্রায়ন এবং অধিক গণতন্ত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবলম্বন বিকেন্দ্রায়নের সুচিন্তিত উদ্যোগ। গণতন্ত্রের সঙ্গে বিকেন্দ্রায়ন ও সক্ষমতা সৃষ্টির সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়।
বিকেন্দ্রায়নের খণ্ডিত প্রয়োগ: আমাদের দেশে বিকেন্দ্রায়ন বললে স্থানীয় সরকারের প্রসঙ্গই সর্বপ্রথমে চলে আসে। অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার ও বিকেন্দ্রায়নকে এক করে ফেলা হয়। বিকেন্দ্রায়ন একটি অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক পরিবর্তন বিষয়ক ধারণা। বিকেন্দ্রায়নের রয়েছে বহুমুখী প্রয়োগ এবং এটি বহুমুখী কর্মকাণ্ডের মিলিত প্রক্রিয়া ও ফলাফল। রাজনীতিই মূলত একটি দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিকেন্দ্রায়নের গতি, প্রক্রিয়া ও ফলাফল নির্ধারণ করে থাকে। বিকেন্দ্রায়ন কোনো কৃত্-কৌশলগত সিদ্ধান্ত নয়, রাজনীতিই এর গতি নির্ধারণ করবে। কারণ ক্ষমতার সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক চিঠি ও খামের মতো। একের ভার অন্যকেই বহন করতে হয়। রাজনীতিই মূলত নির্ধারণ করবে ক্ষমতার (১) কোন অংশ, কতটুকু (২) কোথায় (৩) কারা (৪) কীভাবে প্রয়োগ করবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র এখনো এ চারটি ক্ষেত্রের ওপর সুনির্দিষ্ট আইনগত, প্রশাসনিক, ব্যবহারিক ও সাংস্কৃতিক সামঞ্জস্য বিধান করতে পারেনি।
‘ক্ষমতা’ সমস্যা ও সংকট নিরসনের জন্য, নতুন সংকট সৃষ্টির জন্য নয়: স্থান-কাল-পাত্র ও বিষয়ভেদে সমস্যা ও সংকট নিরসনের জন্যই প্রয়োজন সঠিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হাতে প্রয়োজনীয় ক্ষমতা (power and authority)। কিন্তু আমাদের এই নবীন রাষ্ট্রে ‘ক্ষমতা’ নিজেই সমস্যা হিসেবে প্রতিভাত। ক্ষমতার নিজস্ব বলয় থেকে অনেক সমস্যা ও সংকটের উদ্ভব ও বিকাশ। ক্ষমতার অতিকেন্দ্রিকতা তার একটি অন্যতম প্রধান কারণ।
বিশ্বের কোথাও ক্ষমতা সম্পূর্ণ কেন্দ্রীভূতও নয় আবার সম্পূর্ণ বিকেন্দ্রায়িতও নয়। পরিবেশ, পরিস্থিতি ও অবস্থা কেন্দ্রায়ন-বিকেন্দ্রায়নের ভারসাম্য রক্ষা করে। মনুষ্য শরীরের মতো সমাজের শরীর বা body politic একটি সাধারণ নিয়ম মেনে কাজ করে। মনুষ্য শরীরে সব অঙ্গের আন্তঃসম্পর্ক ও আন্তঃঅঙ্গীয় সমন্বয় একটি কেন্দ্রীয় শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। নাকে মাছি বসলে তা চোখ দেখে না, নাক নিজে থেকে সে মাছি তাড়াতেও পারে না। কোনো এক অদৃশ্য শক্তি হাতকে দ্রুত সচল করে মাছি তাড়াতে উদ্বুদ্ধ করে। সমাজদেহে ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে কেন্দ্রীয় শক্তির অস্তিত্ব অপরিহার্য। কিন্তু মাথা কখনো হাতের কাজ করতে পারে না। তাই তো চোখ, কান, নাক, হাত, পায়ের পৃথক পৃথক অবস্থা ও অবস্থান রয়েছে। হাতে আবার আঙুল, আঙুলের মাথায় আবার নখ, তারও সুনির্দিষ্ট কাজ রয়েছে, নখ ছাড়া আঙুল এবং আঙুল ছাড়া হাত কখনো শক্তিশালী হবে না। তাই হাতকে শক্তিশালী করতে গেলে নখ ও আঙুলের সযত্ন লালন ও ব্যবহার অবধারিত। যার কাজ তাকে করতে দিতে হলে প্রত্যেকের একদিকে স্বকীয়তা এবং স্বাধীনতার প্রতি সম্মান, অন্যদিকে আন্তঃসম্পর্ক ও মিথস্ক্রিয়ার বিকাশ প্রয়োজন। এ বিকাশের নাম ও কৌশলই বিকেন্দ্রায়ন।
অতিকেন্দ্রায়ন বা ক্ষমতাচর্চার অতিকেন্দ্রীকৃত অবস্থা শুধু রাষ্ট্র নয়, যেকোনো সংগঠন, এমনকি পারিবারিক জীবনের জন্যও অস্বস্তিকর, সম্পর্কবিনাশী ও অকল্যাণকর। বিজ্ঞ, বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা বিকেন্দ্রায়নের মাধ্যমে নিজেদের বেশি মাত্রায় বিকশিত করেন। বোকারা ক্ষমতাকে ভাগাভাগি ও বিকশিত না করে মুষ্টিবদ্ধ করতে গিয়ে নিজেরাই নিজেদের ক্ষমতার কারাগারে বন্দি হয়ে যান। ক্ষমতা একটি যন্ত্রণাময় সম্পর্ক জাল। এখানে বেশি জড়িয়ে গেলে বের হওয়ার পথ সংকুচিত হয়। অতি ক্ষমতা মানুষকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে। ক্ষমতার প্রতি অতি অনুরাগ, মাদকতা ও উন্মাদনায় কিছু মানুষ পাগল হয়ে যায়। গ্রিক পৌরাণিক সাহিত্যে কিং মিডাসের স্বর্ণ অনুরাগের মতো। শেষ পর্যন্ত তাকে দেয়া দেবতার স্পর্শমাত্র স্বর্ণে রূপান্তরের বর শাপে পরিণত হয়। ইতিহাসের অনেক মহানায়কের করুণ পরিণতি সীমাহীন ও বাধাবন্ধনহীন ক্ষমতার প্রতি অতি অনুরাগ থেকেই সৃষ্ট।
ক্ষমতা ভোগ করার বিষয় ও বস্তু নয়, ক্ষমতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের সম্পর্কটিই প্রধান। ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, এর প্রয়োগ যোগ্যতা এবং প্রয়োগ-পরবর্তী ফলাফলের উত্কর্ষ-অপকর্ষ। ‘ক্ষমতা’ কোনো কোনো বিশেষ বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়লে তার প্রয়োগযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। তাই আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজে ক্ষমতাকে উপযুক্ত পথ ও পন্থায় ছড়িয়ে দেয়া হয়। তাতে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজের সব আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক সংগঠন সর্বত্রই ক্ষমতায়ন হয়। ভেতর থেকে ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়া বিকশিত হলে দায়িত্ব বণ্টন ও স্বতঃপ্রণোদিত দায়িত্ব গ্রহণ প্রক্রিয়া শক্তিশালী হয়। এতে ক্ষমতার ব্যাপ্তি ও ব্যাপকতা বেড়ে যায়। যেমন— একজন শুধু বটবৃক্ষ হতে চাইলে অন্য সব লতাগুল্ম মরে যায়, কিন্তু শত বীজ ছড়িয়ে দিলে ফুলে ফসলে পুরো ধরিত্রী সুশোভিত হয়। তাই ক্ষমতাকে ছড়িয়ে দেয়ার মধ্যে নিজেকে বিস্তৃত ও বিকশিত করা হয়। এতে মূল কেন্দ্রের ক্ষমতা কমে না, তা শতগুণে বৃদ্ধি পায়। সঙ্গে সঙ্গে পুরো সমাজের সক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়।
ক্ষমতার কেন্দ্রায়ন প্রবণতা চিরন্তন। কিন্তু ক্ষমতা ছড়িয়ে দেয়ার বিষয়টি ব্যতিক্রম। ক্ষমতা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য আবার ভিন্নধর্মী ক্ষমতা, শক্তি ও সক্ষমতা প্রয়োজন। কারণ বিকেন্দ্রায়ন বা বিকেন্দ্রীকরণ মানে সব কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের বিলোপ নয়, বরং বিকেন্দ্রায়নের ফলে কেন্দ্রের নজরদারি, পরামর্শ ও নির্দেশনা আরো বেড়ে যেতে পারে। বিকেন্দ্রায়ন সত্যিকার অর্থে দায়িত্বের অংশীদারিত্ব, দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নয়।
বিকেন্দ্রায়ন বা বিকেন্দ্রীকরণের চারটি প্রধান প্রকার, প্রকৃতি ও অবস্থা রয়েছে, যার নির্যাসকে প্রশাসনিক (Deconcentration), রাজনৈতিক (Devolution), বিশেষায়ন (Delegation) এবং আর্থসামাজিক (Privatation) চারটি বাংলা শব্দ ও ধারণায় প্রকাশ করা যায়। বিকেন্দ্রীকরণের তত্ত্বীয় পাঠে চারটি অবস্থা নিম্নরূপভাবে দেখা যায়।
১. বিপুঞ্জীভূতকরণ (Deconcentration) মূলত প্রশাসনিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ বোঝায়। এটি মূলত ব্যবস্থাপনাগত কৌশল ও সম্পর্ককে অধিক পরিমাণে নির্দেশ করে। এটি একটি প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে এক বা একাধিক প্রতিষ্ঠান। আবার প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে বিভিন্ন বিভাগ ও শাখার মধ্যে, প্রতিটি দায়িত্বশীল পদের মধ্যে ক্ষমতা ও কাজের বণ্টন এবং বিভাজনকে নির্দেশ করে। যেমন— মন্ত্রণালয়, অধিদফতর, পরিদফতর আবার মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরে বিভাগ, অনুবিভাগ, শাখা; অন্যদিকে মন্ত্রী, সচিব, অতিরিক্ত, যুগ্ম, উপ ও সহসচিবের মধ্যে দায়িত্ব ও ক্ষমতার সীমারেখা নির্ধারণ করে। সে নির্ধারিত বলয়ে তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারই প্রশাসনিক বিকেন্দ্রায়নের পর্যায়ে পড়ে।
২. রাজনৈতিক ও আইনগত ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ (Devolution) একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপট। এখানে আসে জাতীয় বা কেন্দ্রীয় পর্যায় এবং তার নিম্নে আর কোন কোন পর্যায়ে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ সম্প্রসারিত হবে সে প্রশ্ন। যেমন— একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতিতে ন্যাশনাল ও সাব-ন্যাশনাল পর্যায়ে ক্ষমতা ও রাষ্ট্রীয় কাজের কেন্দ্রবিন্দু, মধ্যবিন্দু, নিম্ন এবং নিম্নতম ক্ষমতা কেন্দ্র সৃষ্টি করা হয়। এ কেন্দ্রগুলো ক্ষমতা ও কর্মবণ্টন সংবিধান ও আইনের মাধ্যমেই হয়। যেমন— যুক্তরাষ্ট্রীয় বা এককেন্দ্রিক সরকারের কাঠামো নির্ধারণের পর তা যুক্তরাষ্ট্রীয় হলে সেখানে ফেডারেল গভর্নমেন্ট, স্টেট, প্রাদেশিক বা রাজ্য সরকার, তার পরের স্তরে স্থানীয় সরকার। এ তিনটি ভিন্ন ধরনের সরকারের রূপ, কাঠামো ও আদল তৈরি হয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় বা এককেন্দ্রিক, রাষ্ট্রপতি শাসিত কিংবা সংসদীয় পদ্ধতি এবং রাজতন্ত্র বা প্রজাতন্ত্র সর্বত্রই কেন্দ্র বা জাতীয় সরকারের নিচে একাধিক রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ সৃষ্টি করে ক্ষমতার বিন্যাস করা হয়।
৩. প্রত্যর্পণ (Delegation) প্রক্রিয়ায় মূলত সাধারণী (Generalist) প্রশাসনের অধীনে বিশেষায়িত পৃথক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা হয়। সেখানে বিশেষায়িত কাজের সব দায়িত্ব নতুন সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানে প্রত্যর্পণ করে দেয়া হয়। যেমন— স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বাস্থ্য অধিদফতর আবার তার অধীনে সাধারণ ও বিশেষায়িত হাসপাতাল। সড়ক ও জনপথ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিআরটিএ কিংবা ‘সেতু কর্তৃপক্ষ’, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ইত্যাদি।
৪. বিরাষ্ট্রীকরণ (Privatation) উপরের তিনটি ধরন মূলত রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সঙ্গে সম্পৃক্ত। চতুর্থ স্তম্ভ বা ধরনটি হচ্ছে, রাষ্ট্র কিছু ক্ষমতা ও কার্য সরাসরি ব্যক্তি উদ্যোগ, বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ কিংবা বাজার ব্যবস্থার ওপর ছেড়ে দিতে পারে। এটি মূলত অর্থনৈতিক ও সেবা কর্মকাণ্ড, যা রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া প্রভাব হ্রাস করে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক হয়। এতে ব্যক্তি ভোক্তার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, সেবা ও কর্মের উত্পাদন, বণ্টন, বিক্রয় প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়। ফলে উত্পাদনশীলতা, শ্রম ব্যবস্থা, পণ্যের মান, গুণ ও মূল্য নির্ধারণ সর্বত্র ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। আমাদের টেলিফোন ব্যবস্থা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এজন্য বিরাষ্ট্রীয়করণ, বি-আমলাকরণ এবং ডি-রেগুলেশন কার্যকর ভূমিকা রাখে। ব্যক্তির পছন্দের পরিসর বৃদ্ধি পায়। রাষ্ট্র ও আমলা নির্ভরতা হ্রাস পায়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র সরাসরি পণ্য ও সেবা উত্পাদন, বণ্টন ও ব্যবস্থাপনা করে না, কিন্তু বিষয়টির ওপর পরিপূর্ণ রেগুলেটরি নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। যেমন— হয়তো ভোগ্যপণ্যের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণে বিএসটিআই, অর্থ ও মুদ্রা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক, অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে দুর্নীতি দমন কমিশন, ওমবুডস্ম্যান (ন্যায়পাল) প্রভৃতি সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেবে। সার্বিক আইন-শৃঙ্খলার জন্য পুলিশ ব্যবস্থা কার্যকর থাকবে। এ ব্যবস্থায় নির্দেশনার চেয়ে প্রণোদনা ও আইনের শাসনকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে choice ও voice অনেক বেশি গুরুত্ব পায়।
[বিআইজিডির (ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়) সঙ্গে যুক্ত কনসার্ন সিটিজেনের পক্ষে ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে প্রবন্ধটি উপস্থাপিত]

লেখক: স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ
সাবেক অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.