ইরান বনাম ইসরাইল-আমেরিকা (Iran Vs Israel-US)
ইরান বনাম ইসরাইল-আমেরিকা জোটের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা কতটুকু?
(একটি আবেগ বিবর্জিত বাস্তব সম্মত পর্যালোচনা)ঃ
ধর্মীয় সেন্টিমেন্টের কারণেই হোক কিংবা ইরানের কট্টর আমেরিকা বিদ্বেষী মনোভাবের কারণেই হোক, আমাদের অনেকের মনেই ইরানের জন্য একটা soft corner তৈরী হয়েছে। ফলশ্রুতিতে আমরা অনেকেই অতি আবেগের বর্শবর্তী হয়ে এরকম মনোভাব পোষণ করি যে আমেরিকা ইরানের সাথে যুদ্ধ করার সাহস করেনা বা সামনে ইরানকে আক্রমণ করার মত কোন অভিপ্রায় আমেরিকার নেই যা কিছুদিন আগে মাইক পম্পেই নিশ্চিত করেছেন। আসলেই কি আমেরিকা ইরানকে আক্রমণ করতে চায়না? সত্যিই কি আমেরিকা ইরানের সাথে সংঘাত চাইছেনা? আসুন আমরা ধর্মীর আনুভতি আর আবেগের বাইরে গিয়ে এর বাস্তবসম্মত পর্যালোচনা করি।
পৃথিবীতে যখনই কোনো মুসলিম দেশ সামরিক দিক দিয়ে এগিয়ে গেছে তখনই কিছু কূটকৌশল ব্যবহার করে প্রথমে সেই মুসলিম দেশকে দূর্বল করেছে,তারপর সমন্বিত বহুজাতিক আক্রমণ করে সেই দেশকে ধ্বংস্তুপে পরিণত করেছে আমেরিকা ও তার মিত্রজোট। তারা যে কূটকৌশলগুলো ব্যবহার করেছে সেগুলো হলোঃ
★ প্রথমত সেই দেশে গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক বাড়িয়ে দিয়ে তাদের সামরিক সক্ষমতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া।
★ সেই দেশে নিজেদের এজেন্টদের কাজে লাগিয়ে ব্যপক বিশৃঙ্খলা তৈরী করা।
★দেশের মানুষের ভিতরে ঐক্য ধ্বংস করা কারণ তারা জানে ঐক্য বিনষ্ট করতে পারলে যুদ্ধে জেতা খুবই সহজ হয়ে যায়।
★ অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে সেই দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেয়া।কারণ যুদ্ধ শুরু হলে অস্ত্র কেনার জন্য ব্যাপক অর্থের দরকার। অর্থ সংকট থাকলে স্বাভাবিক ভাবেই সেই দেশ সবদিক থেকে পিছিয়ে যাবে।
★আক্রমণের ঠিক আগমুহূর্তে বহুজাতিক জোট তৈরী করে আক্রমন পরিচালনা করা। এতে যুদ্ধের ব্যয় এবং হেরে যাওয়ার সম্ভাবনা দুটোই কমে যায়।
★ টার্গেটকৃত দেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকে সেই রাষ্ট্রের চরম বিরোধী করে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা করা।
★টার্গেটকৃত রাষ্ট্রের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে সামরিক ঘাঁটি নির্মান করা যাতে কাছ থেকে অতি সহজেই হামলা করা যায়।
ইরানের ক্ষেত্রেও তারা এর সবগুলো কূটকৌশল ব্যবহার করেছে এবং এখনো করছে যা প্রতিটি চিন্তাশীল মানুষকেই নিশ্চিত করে যে ইসরাইল-আমেরিকা ইরানে হামলা করার জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করছে।
১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামিক বিপ্লবের পর আমেরিকা বুঝতে পেরেছিল, ইরানের এই বিপ্লব ইরাকেও রপ্তানি হতে পারে। আর এই বিপ্লবের মাধ্যমে ইরান হতে যাচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম মুসলিম পরাশক্তি। তারা দেরী না করে বিপ্লবের এক বছরের মধ্যে ইরানের সাথে ইরাকের যুদ্ধ বাধায়ে দেয়। এই যুদ্ধ দীর্ঘ ৮ বছর স্থায়ী হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল ইরানের পরাশক্তি হওয়ার সম্ভাবনা অংকুরেই বিনষ্ট করে দেয়া। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি বরং ইরাক-ইরান সন্ধির মাধ্যমে তাদের এই সংঘাতের পরিসমাপ্তি ঘটে।
বিপ্লবের পর থেকেই ইরান ইসরাইলকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে দেওয়ার হুমকি দিয়ে আসছে।কিন্তু এর জন্য দরকার অনেক শক্তি। এর অংশ হিসেবে ইরান ২০০৬ সালে পারমানবিক কার্যক্রম শুরু করে যা ইসরাইলের ভবিষ্যতকে রীতিমত চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দেয়। সেই সাথে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার স্বার্থ খর্ব করার এক প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত বহন করে। আমেরিকা তখন বেশ ভালভাবেই বুঝতে পারে, আজ কিংবা কাল হোক, ইরানের সাথে সংঘাত অনিবার্য। সরাসরি যুদ্ধে জড়ালে ক্ষতি অনেক বেশী হওয়ার সম্ভাবনা আছে কারণ হরমুজ প্রণালী ইরানের দখলে। আর হরমুজ প্রণালী এমন একটি প্রণালী যা দিয়ে বহিঃবিশ্বে পৃথিবীর মোট রপ্তানির ৩০% তেল পরিবহন করা হয়। তাই সরাসরি ইরানে হামলা করলে ইরান হরমুজ বন্ধ করবে। আর হরমুজ বন্ধ হলে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বিদ্যুৎ গতিতে বেড়ে যাবে। আর তেল এমনি এক সম্পদ যা ছাড়া আধুনিক বিশ্ব কল্পনাই করা যায়না। চিন্তা করুন, বাস-ট্রাক- ট্যাংক থেকে শুরু করে আকাশের বিমান অবধি অধিকাংশ ইঞ্জিন তেলের মাধ্যমে চলে। আপনার অনেক গাড়ী আছে, বিমান আছে, ক্ষেপনাস্ত্র আছে কিন্তু তার জ্বালানি তেল না থাকলে সেগুলো অচল। তাই ঠান্ডা মাথায় প্রথমে ইরানকে দূর্বল করার জন্য বিভিন্ন কূটকৌশল চালায় আমেরিকা। শিয়া-সুন্নি বিভক্তিকে উস্কে দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে ইরানের মহা শত্রুতে পরিণত করে তারা। ওদিকে ইসরাইলের মোসাদকে কাজে লাগিয়ে ইরানের সেরা সেরা পাঁচ জন পরমানু বিজ্ঞানীকে হত্যা করে তারা। ইরানের উপরে বারবার অর্থনৈতিক অবরোধ চাপিয়ে তাদের অর্থনীর মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেওয়ার চেষ্টা করে।ইরান পারমানবিক অস্ত্র তৈরী করছে এই ধূয়া তুলে ইউরোপ আর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে ইরানের প্রচন্ড বিরোধী করে গড়ে তোলে। ইরান আক্রমন চালাতে পারে এরকম ভয় ভীতি দেখিয়ে কাতার, সৌদি আরব, জর্ডান, কুয়েত, আরব আমিরাত সহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে বেশ কিছু ঘাঁটি গেঁড়ে বসে তারা।যাতে ইরানকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলা যায়।কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে তারা ইরাক, আফগানিস্তান এবং লিবিয়াকেও ধ্বংস্তুপে পরিণত করে। কিন্তু তারা ইরানে হামলা করেনি। ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে ইসরাইলের ধর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। নেতানিয়াহু প্রকাশ্যে ইরানে হামলার হুমকি দেন। সেসময় বিশ্ব অনেকটা নিশ্চিত হয়েছিল এইবার সত্যিই ইসরাইল-আমেরিকা ইরানে হামলা করতে যাচ্ছে। কিন্তু এক অজানা কারণে ইসরাইল-আমেরিকা জোট ইরানে হামলা চালানো হতে বিরত থাকে। পরে কিছু স্পর্শকাতর নথি প্রকাশ হয় যাতে দেখা যায় নেতানিয়াহু বারাক ওবামাকে রাজি করাতে পারেননি বলে সেই যুদ্ধের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। বারাক ওবামা বুঝেছিলেন যতদিন ইরানের হাতে হরমুজের Control থাকবে ততদিন অবধি আমেরিকাকে ধর্য্য ধরতে হবে। ভুল করলেই আমেরিকা হয়ত যুদ্ধে জিতে যাবে কিন্তু পৃথিবীর মোড়লগিরি তার হাত থেকে ফসকে যাবে।
ওদিকে ইরান খুব ভালমতই বুঝতে পেরেছিল যে ইসরাইল-আমেরিকা তাকে আজ কিংবা কাল হোক হামলা করবেই। তাই তারাও এবার আমেরিকা-ইসরাইলের কূটনীতিতে তাদেরই ঘায়েল করার সিদ্ধান্ত নিল। ইরান ইসরাইলের পাশেই তার এমন দুটো শক্তিশালী মিত্র আর ইসরাইলের চরম শত্রু তৈরী করল যা ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিল। তাদের একটি হিজবুল্লাহ অন্যটি হামাস। হিজবুল্লাহকে সিরিয়ার মধ্য দিয়ে আর হামাসকে মিশর-ফিলিস্তিন সীমান্তে থাকা রাফা ক্রসিং দিয়ে অস্ত্র সরবরাহ করত ইরান। ইরান বুঝতে পেরেছিল যে, ২০০০ কি.মি. দূর থেকে ইসরাইলে আঘাত করার চেয়ে ইসরাইলের সীমান্তের কাছে থেকে তাদের আক্রমণ করা খুবই সহজ। হিজবুল্লাহ আর হামাসকে ইরান এমনভাবে সাহায্য করত যেন তারা ইরানের সেনাবাহিনীরই একটি অংশ।
২০১২ সালে মিশরে মুরসি সরকার ক্ষমতায় গেলে রাফা ক্রসিং দিয়ে হামাসকে অস্ত্র সরবরাহ করা অনেকগুণ বেড়ে গেল। আমেরিকা- ইসরাইল ভাবল, ইরান যে হারে হামাসকে অস্ত্র সরবরাহ করছে এই অবস্থা চলতে থাকলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ইসরাইলকে হামাসের হাতে নাকানি চুঁবানি খেতে হবে। তারা এই সমস্যার সমাধানের জন্য মিশরের মুরসি সরকারকে উৎখাত করে তাদের তাবেদার সিসি কে ক্ষমতায় বসালো। সি.সি. ক্ষমতায় এসেই রাফা ক্রসিং এ বিশাল পরীখা খনন করে হামাসের প্রায় ১৫শত টানেল ধ্বংস করে দিলো। ফলে এ যাত্রায় হামাসের কাছে ইরানের বিপুল অস্ত্র সরবরাহের লাগাম টেনে ধরা গেল।
এরপর সিরয়ার বাশার আল আসাদ সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে তারা হিজবুল্লাহর কাছে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করতে চাইল যা ইরান-সিরিয়া-রাশিয়া-হিজবুল্লাহর সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে আজ অবধি সম্ভব হয়নি।
আপনারা যদি ভেবে থাকেন ইসরাইল-আমেরিকা জোটের ইরানে হামলা করার ইচ্ছে নেই তাহলে সেটা হবে মারাত্মক ভুল। তারা ততক্ষণ অবধি ইরানে হামলা করবেনা যতক্ষণ না হরমুজের control আর হিজবুল্লাহ -হামাসকে অস্ত্র দেয়া অব্যাহত রাখবে ইরান। যখন হরমুজের বিকল্প কোনো পথ তারা পেয়ে যাবে এবং যখন হিজবুল্লাহ হামাসকে অস্ত্র সাপ্লাই দেয়ার পথ বন্ধ করে দিতে পারবে তখন আর কাল বিলম্ব না করে তারা ইরানে হামলা করবে। অন্যথায় ইরানে হামলা চালানোর পরিণামে আমেরিকা জোটকে এত বেশী অর্থনৈতিক আর সামরিক ক্ষতির সন্মুখিন হতে হবে যার আঘাতে পৃথিবীর মোড়লগিরি আমেরিকার হাত থেকে অন্যের হাতে চলে যাবে।
(নোমান বিন নজরুল,)
আন্তর্জাতিক গবেষক,
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
(একটি আবেগ বিবর্জিত বাস্তব সম্মত পর্যালোচনা)ঃ
ধর্মীয় সেন্টিমেন্টের কারণেই হোক কিংবা ইরানের কট্টর আমেরিকা বিদ্বেষী মনোভাবের কারণেই হোক, আমাদের অনেকের মনেই ইরানের জন্য একটা soft corner তৈরী হয়েছে। ফলশ্রুতিতে আমরা অনেকেই অতি আবেগের বর্শবর্তী হয়ে এরকম মনোভাব পোষণ করি যে আমেরিকা ইরানের সাথে যুদ্ধ করার সাহস করেনা বা সামনে ইরানকে আক্রমণ করার মত কোন অভিপ্রায় আমেরিকার নেই যা কিছুদিন আগে মাইক পম্পেই নিশ্চিত করেছেন। আসলেই কি আমেরিকা ইরানকে আক্রমণ করতে চায়না? সত্যিই কি আমেরিকা ইরানের সাথে সংঘাত চাইছেনা? আসুন আমরা ধর্মীর আনুভতি আর আবেগের বাইরে গিয়ে এর বাস্তবসম্মত পর্যালোচনা করি।
পৃথিবীতে যখনই কোনো মুসলিম দেশ সামরিক দিক দিয়ে এগিয়ে গেছে তখনই কিছু কূটকৌশল ব্যবহার করে প্রথমে সেই মুসলিম দেশকে দূর্বল করেছে,তারপর সমন্বিত বহুজাতিক আক্রমণ করে সেই দেশকে ধ্বংস্তুপে পরিণত করেছে আমেরিকা ও তার মিত্রজোট। তারা যে কূটকৌশলগুলো ব্যবহার করেছে সেগুলো হলোঃ
★ প্রথমত সেই দেশে গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক বাড়িয়ে দিয়ে তাদের সামরিক সক্ষমতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া।
★ সেই দেশে নিজেদের এজেন্টদের কাজে লাগিয়ে ব্যপক বিশৃঙ্খলা তৈরী করা।
★দেশের মানুষের ভিতরে ঐক্য ধ্বংস করা কারণ তারা জানে ঐক্য বিনষ্ট করতে পারলে যুদ্ধে জেতা খুবই সহজ হয়ে যায়।
★ অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে সেই দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেয়া।কারণ যুদ্ধ শুরু হলে অস্ত্র কেনার জন্য ব্যাপক অর্থের দরকার। অর্থ সংকট থাকলে স্বাভাবিক ভাবেই সেই দেশ সবদিক থেকে পিছিয়ে যাবে।
★আক্রমণের ঠিক আগমুহূর্তে বহুজাতিক জোট তৈরী করে আক্রমন পরিচালনা করা। এতে যুদ্ধের ব্যয় এবং হেরে যাওয়ার সম্ভাবনা দুটোই কমে যায়।
★ টার্গেটকৃত দেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকে সেই রাষ্ট্রের চরম বিরোধী করে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা করা।
★টার্গেটকৃত রাষ্ট্রের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে সামরিক ঘাঁটি নির্মান করা যাতে কাছ থেকে অতি সহজেই হামলা করা যায়।
ইরানের ক্ষেত্রেও তারা এর সবগুলো কূটকৌশল ব্যবহার করেছে এবং এখনো করছে যা প্রতিটি চিন্তাশীল মানুষকেই নিশ্চিত করে যে ইসরাইল-আমেরিকা ইরানে হামলা করার জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করছে।
১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামিক বিপ্লবের পর আমেরিকা বুঝতে পেরেছিল, ইরানের এই বিপ্লব ইরাকেও রপ্তানি হতে পারে। আর এই বিপ্লবের মাধ্যমে ইরান হতে যাচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম মুসলিম পরাশক্তি। তারা দেরী না করে বিপ্লবের এক বছরের মধ্যে ইরানের সাথে ইরাকের যুদ্ধ বাধায়ে দেয়। এই যুদ্ধ দীর্ঘ ৮ বছর স্থায়ী হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল ইরানের পরাশক্তি হওয়ার সম্ভাবনা অংকুরেই বিনষ্ট করে দেয়া। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি বরং ইরাক-ইরান সন্ধির মাধ্যমে তাদের এই সংঘাতের পরিসমাপ্তি ঘটে।
বিপ্লবের পর থেকেই ইরান ইসরাইলকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে দেওয়ার হুমকি দিয়ে আসছে।কিন্তু এর জন্য দরকার অনেক শক্তি। এর অংশ হিসেবে ইরান ২০০৬ সালে পারমানবিক কার্যক্রম শুরু করে যা ইসরাইলের ভবিষ্যতকে রীতিমত চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দেয়। সেই সাথে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার স্বার্থ খর্ব করার এক প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত বহন করে। আমেরিকা তখন বেশ ভালভাবেই বুঝতে পারে, আজ কিংবা কাল হোক, ইরানের সাথে সংঘাত অনিবার্য। সরাসরি যুদ্ধে জড়ালে ক্ষতি অনেক বেশী হওয়ার সম্ভাবনা আছে কারণ হরমুজ প্রণালী ইরানের দখলে। আর হরমুজ প্রণালী এমন একটি প্রণালী যা দিয়ে বহিঃবিশ্বে পৃথিবীর মোট রপ্তানির ৩০% তেল পরিবহন করা হয়। তাই সরাসরি ইরানে হামলা করলে ইরান হরমুজ বন্ধ করবে। আর হরমুজ বন্ধ হলে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বিদ্যুৎ গতিতে বেড়ে যাবে। আর তেল এমনি এক সম্পদ যা ছাড়া আধুনিক বিশ্ব কল্পনাই করা যায়না। চিন্তা করুন, বাস-ট্রাক- ট্যাংক থেকে শুরু করে আকাশের বিমান অবধি অধিকাংশ ইঞ্জিন তেলের মাধ্যমে চলে। আপনার অনেক গাড়ী আছে, বিমান আছে, ক্ষেপনাস্ত্র আছে কিন্তু তার জ্বালানি তেল না থাকলে সেগুলো অচল। তাই ঠান্ডা মাথায় প্রথমে ইরানকে দূর্বল করার জন্য বিভিন্ন কূটকৌশল চালায় আমেরিকা। শিয়া-সুন্নি বিভক্তিকে উস্কে দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে ইরানের মহা শত্রুতে পরিণত করে তারা। ওদিকে ইসরাইলের মোসাদকে কাজে লাগিয়ে ইরানের সেরা সেরা পাঁচ জন পরমানু বিজ্ঞানীকে হত্যা করে তারা। ইরানের উপরে বারবার অর্থনৈতিক অবরোধ চাপিয়ে তাদের অর্থনীর মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেওয়ার চেষ্টা করে।ইরান পারমানবিক অস্ত্র তৈরী করছে এই ধূয়া তুলে ইউরোপ আর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে ইরানের প্রচন্ড বিরোধী করে গড়ে তোলে। ইরান আক্রমন চালাতে পারে এরকম ভয় ভীতি দেখিয়ে কাতার, সৌদি আরব, জর্ডান, কুয়েত, আরব আমিরাত সহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে বেশ কিছু ঘাঁটি গেঁড়ে বসে তারা।যাতে ইরানকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলা যায়।কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে তারা ইরাক, আফগানিস্তান এবং লিবিয়াকেও ধ্বংস্তুপে পরিণত করে। কিন্তু তারা ইরানে হামলা করেনি। ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে ইসরাইলের ধর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। নেতানিয়াহু প্রকাশ্যে ইরানে হামলার হুমকি দেন। সেসময় বিশ্ব অনেকটা নিশ্চিত হয়েছিল এইবার সত্যিই ইসরাইল-আমেরিকা ইরানে হামলা করতে যাচ্ছে। কিন্তু এক অজানা কারণে ইসরাইল-আমেরিকা জোট ইরানে হামলা চালানো হতে বিরত থাকে। পরে কিছু স্পর্শকাতর নথি প্রকাশ হয় যাতে দেখা যায় নেতানিয়াহু বারাক ওবামাকে রাজি করাতে পারেননি বলে সেই যুদ্ধের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। বারাক ওবামা বুঝেছিলেন যতদিন ইরানের হাতে হরমুজের Control থাকবে ততদিন অবধি আমেরিকাকে ধর্য্য ধরতে হবে। ভুল করলেই আমেরিকা হয়ত যুদ্ধে জিতে যাবে কিন্তু পৃথিবীর মোড়লগিরি তার হাত থেকে ফসকে যাবে।
ওদিকে ইরান খুব ভালমতই বুঝতে পেরেছিল যে ইসরাইল-আমেরিকা তাকে আজ কিংবা কাল হোক হামলা করবেই। তাই তারাও এবার আমেরিকা-ইসরাইলের কূটনীতিতে তাদেরই ঘায়েল করার সিদ্ধান্ত নিল। ইরান ইসরাইলের পাশেই তার এমন দুটো শক্তিশালী মিত্র আর ইসরাইলের চরম শত্রু তৈরী করল যা ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিল। তাদের একটি হিজবুল্লাহ অন্যটি হামাস। হিজবুল্লাহকে সিরিয়ার মধ্য দিয়ে আর হামাসকে মিশর-ফিলিস্তিন সীমান্তে থাকা রাফা ক্রসিং দিয়ে অস্ত্র সরবরাহ করত ইরান। ইরান বুঝতে পেরেছিল যে, ২০০০ কি.মি. দূর থেকে ইসরাইলে আঘাত করার চেয়ে ইসরাইলের সীমান্তের কাছে থেকে তাদের আক্রমণ করা খুবই সহজ। হিজবুল্লাহ আর হামাসকে ইরান এমনভাবে সাহায্য করত যেন তারা ইরানের সেনাবাহিনীরই একটি অংশ।
২০১২ সালে মিশরে মুরসি সরকার ক্ষমতায় গেলে রাফা ক্রসিং দিয়ে হামাসকে অস্ত্র সরবরাহ করা অনেকগুণ বেড়ে গেল। আমেরিকা- ইসরাইল ভাবল, ইরান যে হারে হামাসকে অস্ত্র সরবরাহ করছে এই অবস্থা চলতে থাকলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ইসরাইলকে হামাসের হাতে নাকানি চুঁবানি খেতে হবে। তারা এই সমস্যার সমাধানের জন্য মিশরের মুরসি সরকারকে উৎখাত করে তাদের তাবেদার সিসি কে ক্ষমতায় বসালো। সি.সি. ক্ষমতায় এসেই রাফা ক্রসিং এ বিশাল পরীখা খনন করে হামাসের প্রায় ১৫শত টানেল ধ্বংস করে দিলো। ফলে এ যাত্রায় হামাসের কাছে ইরানের বিপুল অস্ত্র সরবরাহের লাগাম টেনে ধরা গেল।
এরপর সিরয়ার বাশার আল আসাদ সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে তারা হিজবুল্লাহর কাছে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করতে চাইল যা ইরান-সিরিয়া-রাশিয়া-হিজবুল্লাহর সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে আজ অবধি সম্ভব হয়নি।
আপনারা যদি ভেবে থাকেন ইসরাইল-আমেরিকা জোটের ইরানে হামলা করার ইচ্ছে নেই তাহলে সেটা হবে মারাত্মক ভুল। তারা ততক্ষণ অবধি ইরানে হামলা করবেনা যতক্ষণ না হরমুজের control আর হিজবুল্লাহ -হামাসকে অস্ত্র দেয়া অব্যাহত রাখবে ইরান। যখন হরমুজের বিকল্প কোনো পথ তারা পেয়ে যাবে এবং যখন হিজবুল্লাহ হামাসকে অস্ত্র সাপ্লাই দেয়ার পথ বন্ধ করে দিতে পারবে তখন আর কাল বিলম্ব না করে তারা ইরানে হামলা করবে। অন্যথায় ইরানে হামলা চালানোর পরিণামে আমেরিকা জোটকে এত বেশী অর্থনৈতিক আর সামরিক ক্ষতির সন্মুখিন হতে হবে যার আঘাতে পৃথিবীর মোড়লগিরি আমেরিকার হাত থেকে অন্যের হাতে চলে যাবে।
(নোমান বিন নজরুল,)
আন্তর্জাতিক গবেষক,
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments